শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

বছরের ছয়টি ঋতুর মাঝে শীতকাল  গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। বছর ঘুরতেই ঋতুরাজ শীতকাল আমাদের মাঝে আসে নতুন আমেজে। কি নেই শীতের দিনগুলোতে? শীতকাল মানেই পিঠা -পুলি আর খেজুরের রসের গল্প, শীতকাল মানেই নানা ধরনের সবজি যা খাবারে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয়, শীতকাল মানেই ভ্রমণপিপাসুদের আনন্দঘন মুহূর্ত।

এখন কথা বলবো ৭ টি শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে। তবে জেনে নিন শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা-

১। মিষ্টি কুমড়া

মিষ্টি কুমড়া আমাদের অত্যন্ত পরিচিত একটি সবজি। ভর্তা, ভাজি, ঝোল করে খাওয়া যায় । মিষ্টি কুমড়া দিয়ে সুস্বাদু হালুয়া তৈরি করা যায়।

উপাদান সমূহ-

পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ,ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, আয়রন, ফসফরাস, কপার , ভিটামিন এ ,বি কমপ্লেক্স, সি ।

এছাড়াও এটি বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ সবজি।

কার্যকারিতা-

  1. এটি আমাদের দেহে ক্যান্সার প্রতিরোধক কোষ গঠন করে।
  2. আর্টারির দেয়ালে চর্বির স্তর জমতে বাধা প্রদান করে।
  3. চুল ও ত্বক ভালো রাখে । সর্দি কাশি, ঠান্ডা লাগা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
  4. এটি বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় ইহা এক ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা শরীরের ফ্রি রেডিকেল ডেমেজ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  5. গর্ভবতী মায়েদের রক্তস্বল্পতা রোধ করে, অকাল প্রসবের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। চোখের ছানি পড়া রোধ সহ চোখের  রেটিনা কোর্স রক্ষা করে।
  6. ওজন কমাতে ইহা একটি উপযুক্ত খাবার কারণ এটি উচ্চ ফাইবারযুক্ত। মিষ্টি কুমড়ার জুস ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
  7. কুমড়ার বিচিতে প্রচুর পরিমান পটাশিয়াম থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী।
  8. হার্ট ও মস্তিষ্কের সুস্থতায় ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার।
  9. এটি হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

আরও জানুন পেঁপে চাষের সঠিক পদ্ধতি

২। ফুলকপি-

ফুলকপি শীতের মৌসুমে জনপ্রিয় একটি সবজি। ভাজি, নিরামিষ, মাছের তরকারি ও অন্যান্যভাবে এটি খাওয়া যায়।

পুষ্টি উপাদান-

ভিটামিন এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ ,সালফার, আয়রন ,ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ফাইবার ।

কার্যকারিতা-

  1. সালফার যুক্ত হওয়ায়  সালফোরাফেন উপাদানটি ক্যান্সার সেল ধ্বংস করে এবং যেকোন টিউমারের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে।
  2. সালফোরাফেন উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং ও রক্তপ্রবাহ নিয়মিত রেখে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে।
  3. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ও সচল রাখতে ফুলকপির ভিটামিন বি কমপ্লেক্স অনেক উপকারি। এছাড়াও এটি মস্তিষ্কের দুর্বলতা স্মৃতিভ্রমরের সমস্যায় সহায়ক ।
  4. ভিটামিন এ ও সি সমৃদ্ধ হওয়ায় ঠান্ডা- জ্বর , সর্দি-কাশি ও টনসিলের প্রদাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
  5. ফুলকপি দেহ গঠনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে । কারণ  ইহা কোলেস্টেরল মুক্ত।
  6. আয়রন সমৃদ্ধ থাকায় বাড়ন্ত শিশু ও গর্ভবতী মায়ের আয়রনের চাহিদা মেটাতে ফুলকপি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার।

৩। বাঁধাকপি

শুধু পাতা আর পাতা । আমাদের দেশে শীত মৌসুমে অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি বাঁধাকপি।এটি আমাদের দেশের সমগ্র অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায় । বাঁধাকপির ভাজি, ডালনা, ফাস্টফুড আইটেম এ কোলস্লো-উফফ আরো কত কি? আসুন জেনে নিই এর পুষ্টি উপাদান ও কার্যকারিতা সম্পর্কে-

 উপাদান-

ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ক্যালসিয়াম ,পটাশিয়াম ,ফাইবার, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন ,

প্যানটোথেনিক অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন, এন্টি অক্সিডেন্ট ইত্যাদি।

কার্যকারিতা-

  1. এটি ক্যান্সার প্রতিরোধক সেল তৈরি করে।
  2.  ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় বাঁধাকপি ওজন কমাতে সাহায্য করে।
  3. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় বাঁধাকপি হাড়কে মজবুত করে।
  4. বাঁধাকপির রস খেলে আলসারের সমস্যা দূর হয়।
  5. বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ থাকায় বাঁধাকপি আমাদের চোখের জন্য খুবই উপকারী।
  6. বাঁধাকপি ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ হওয়ায় চুলের জন্য অনেক উপকারী।
  7. বাঁধাকপিতে ফলিক এসিড যা আমাদের শরীরের ডিএনএ পুনর্গঠন করে থাকে।বাঁধাকপিতে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও আমাদের সুস্থ রাখে।

আরও জানুন

৪। টমেটো-

টমেটো টকজাতীয় সুস্বাদু খাবার যা সালাদ, ভর্তা ,ভাজি , তরকারি নানা ভাবেই খাওয়া যায়। ইহা বাঙালির একটি জনপ্রিয় শীতকালীন সবজি।

উপাদান-

ভিটামিন এ ,ফাইবার ,মিনারেল ,ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ,রিবোফ্লাভিন,

সামান্য পরিমাণে ভিটামিন ডি ,সালফার ও প্রচুর পানি।

কার্যকারিতা-

  1. টমেটো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ হওয়ায় আমাদের দাঁতের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী।
  2. টমেটো থায়ামিন সমৃদ্ধ হওয়ায় হৃদপিন্ডের জন্য অত্যন্ত উপকারী সবজি।
  3. টমেটোতে ভিটামিন সি থাকে যা আমাদের দেহে সর্দি-কাশি সহ নানা রোগ প্রতিরোধ করে থাকে।
  4. টমেটোতে ভিটামিন এ থাকে যা আমাদের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং এটি রাতকানা রোগ নিরাময় করতে সক্ষম হয়।
  5. টমেটোতে সালফার থাকায় এটি ফুসফুস ক্যান্সার ও যকৃত ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।

৫। লাউ

লাউ শীতকালীন সময়ে আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় সবজি। আমাদের দেশের সমগ্র অঞ্চল জুড়ে লাউ পাওয়া যায়। চলুন জেনে নিই – লাউয়ের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ-

উপাদান-

ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ফাইবার, আয়রন,

ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং প্রচুর পরিমাণে পানি।

কার্যকারিতা-

  1. লাউয়ের জিংক উপাদানটি আমাদের দেহকে হৃদ রোগ থেকে রক্ষা করে।
  2. লাউকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পথ্য হিসেবে ধরা হয়। এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
  3. লাউ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
  4. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় লাউ আমাদের দাঁত ও হাড়ের গঠনে সহায়তা করে।
  5. লাউ একটি পানি জাতীয় সবজি । তাই এটি সহজেই আমাদের দেহের পানিশূন্যতা দূর করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা করে।
  6. লাউ খেলে ঘুম ভালো হয় । যাদের ঘুম কম হয় তাদের জন্য লাউ অত্যন্ত উপকারী সবজি।

৬। ঝিঙ্গা

যে কোন সবজির তুলনায় ঝিঙ্গা অতুলনীয় স্বাদ যুক্ত খাবার। ঝিঙ্গা সারাবিশ্বে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে স্বীকৃত। ভর্তা, ভাজি ,তরকারি অনেকভাবেই ঝিঙ্গা খাওয়া যায় । আসুন জেনে নেই পুষ্টিকর উপাদান ও এর উপকারিতা সম্পর্কে-

উপাদান

ঝিঙ্গাতে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, রিবোফ্লাভিন, জিংক ,আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম,

খনিজ পদার্থ, আমিষ, ক্যালসিয়াম , শর্করা ও ফাইবার।

কার্যকারিতা

  1. ঝিঙ্গাতে খুবই কম ক্যালোরি এবং এতে চর্বি নেই । তাই এটি শরীরের কোলেস্টেরল কমায়।
  2. ঝিঙ্গাতে রয়েছে প্রচুর পানি তাই এটিকে ওজন কমানোর মহাঔষধ বলা যায়।
  3. রক্তকে দূষণমুক্ত করতে ঝিঙে অতুলনীয়। ইহা যকৃতের জন্য খুবই উপকারী। ইহা অ্যালকোহলের ক্ষতিকর প্রভাব দূর করে।
  4. জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঝিঙ্গে একটি আদর্শ সবজি।
  5. এতে প্রচুর ফাইবার থাকায় এটি পাকস্থলী ভালো রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
  6. এটি এসিডিটি ও আলসার নিরাময় করে , হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
  7. ঝিঙেতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী খাবার।
  8. এটি বিভিন্ন রোগ জীবাণু ,ভাইরাস ,ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে এবং শরীরের বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয়।

৭। শীম

সিম শীতকালীন সময়ের জনপ্রিয় একটি সবজি । বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই শীম পাওয়া যায় । শীম খাওয়া পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়াই যেন দুষ্কর । আসুন জেনে নেই সিমের উপকারিতা ও এর উপাদান সম্পর্কে-

উপাদান

এতে রয়েছে- প্রোটিন, অল্প পরিমাণ শর্করা, ক্যালসিয়াম, আয়রন,

জিংক, ভিটামিন সি,  খনিজ পদার্থ।

কার্যকারিতা

শীম নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।

শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের অপুষ্টি দূর করতে এটি বেশ উপকারী।

চুল পড়া রোধ করে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

সিলিকন জাতীয় উপাদান থাকায় হাড়কে সুগঠিত করে।

এটি নিয়মিত খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে।

রক্ত আমাশয় দূর করতে শিমের ফুল অন্যতম।

এটিতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় , ডায়াবেটিস রোগীদের অন্যতম পথ্য হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।

পরিশেষে এ কথা বলা যায় শীত কালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সবজি রয়েছে যা খেলে আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকার হবে এবং আমরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারবো। উপরের আলোচনা থেকে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমাদের শীতকালীন সবজির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *